কর্ম-কর্তব্যবাদের গ্রহণযোগ্যতা আলোচনা করো। অথবা, কর্ম-কর্তব্যবাদের সমালোচনাগুলি উল্লেখ করো।
কর্ম-কর্তব্যবাদের গ্রহণযোগ্যতা
নৈতিকতার ক্ষেত্রে কর্ম-কর্তব্যবাদ কখনোই একটি সন্তোষজনক মতবাদরূপে গ্রাহ্য হতে পারে না, কারণ, অধ্যাপক ফ্রাকেনা তাঁর Ethics গ্রন্থে কর্ম- কর্তব্যবাদের বিরুদ্ধে যে সমালোচনাগুলি উল্লেখ করেছেন, তা হল-
[1] পরিস্থিতি ভিন্ন হলেও সম্পূর্ণভাবে নতুন কিছু নয়
কর্ম-কর্তব্যবাদীরা শুধু পরিস্থিতির বিচারের ওপরই সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁরা এও বলেছেন যে, প্রত্যেকটি পরিস্থিতিই হল নতুন নতুন এবং ভিন্ন ভিন্ন। সুতরাং, নিত্যনতুন ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে আমাদের ঠিক কী করণীয়-তা উদ্ভূত পরিস্থিতিই স্থির করে দেয়। কিন্তু বলা যায় যে, কর্ম-কর্তব্যবাদীদের এরূপ যুক্তিটি কখনোই যথার্থ নয়। কারণ, এ কথা ঠিক যে, প্রত্যেকটি পরিস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের এবং অবশ্যই তা নতুনত্বের পরিচায়ক। কিন্তু তার সঙ্গে এ কথাও ঠিক যে, পরিস্থিতিগুলির নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রে কিছুকিছু মিলও দেখা যায়। সুতরাং দাবি করা সংগত যে, কোনো পরিস্থিতিই সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র বা বিচ্ছিন্ন ও সম্পূর্ণ নতুন হতে পারে না। সুতরাং বলা যায় যে, কর্ম-কর্তব্যবাদীদের দাবিকে সমর্থন করা সংগত নয়।
[2] স্বজ্ঞাবৃত্তির অস্বীকৃতি
স্বজ্ঞাবাদীদের স্বজ্ঞা (Intuition)-র সাহায্যে কর্ম-কর্তব্যবাদীরা আমাদের পরিস্থিতির বিচার করতে চেয়েছেন এবং আমাদের করণীয় কর্তব্য স্থির করতে চেয়েছেন। কিন্তু মনোবৈজ্ঞানিকরা আমাদের এরূপ কোনো বৃত্তির কথা অস্বীকার করেছেন। নৃতাত্ত্বিকরা ওই একই অভিমত পোষণ করেন। তা ছাড়াও উল্লেখ করা যায় যে, স্বজ্ঞা বা সাক্ষাৎ প্রতীতি বলে যদি কিছু থেকেই যায়, তাহলে তার দ্বারা করণীয় কর্তব্যের বিষয়টি সকলের ক্ষেত্রেই একই হত, কিন্তু তা কখনোই হয় না। কারণ, কোনো বিষয়ের করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে আমাদের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায় এবং এরূপ পার্থক্যের বিষয়টিই স্বজ্ঞার বিষয়টিকে অপ্রমাণিত করে।
[3] অস্তিত্ববাদীদের অস্তিত্বমূলক সিদ্ধান্তের অগ্রহণযোগ্যতা
কর্ম- কর্তব্যবাদীরা করণীয় কর্তব্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে অস্তিত্ববাদীদের যে অস্তিত্বমূলক সিদ্ধান্তের কথা বলেছেন, তাও কিন্তু গ্রহণীয় নয়। কারণ, পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ শুধু ওই পরিস্থিতি সম্পর্কেই তথ্য প্রদান করতে পারে, কখনোই কোনো কর্মপন্থার নির্দেশ দিতে পারে না। সুতরাং উল্লেখ করা যায় যে, অস্তিবাদীরা যে অস্তিত্ববাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও করণীয় কর্তব্যের কথা বলেছেন, তা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।
[4] লক্ষ্যের বিভ্রান্তিতে কর্ম-কর্তব্যবাদের অচলতা
কর্ম-কর্তব্যবাদীরা কর্ম-কর্তব্যের ক্ষেত্রে কোনো নৈতিক মানদণ্ডের উল্লেখ করেননি। তাঁরা শুধু পরিস্থিতির ঔচিত্যমূলক বিচারবিশ্লেষণের কথা বলেছেন। কিন্তু আমাদের কর্ম-কর্তব্যের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হল কেবল কর্ম-কর্তব্যেরই নৈতিক বিচার করা, কোনো পরিস্থিতির নৈতিক বিচার করা নয়। সে কারণেই দাবি করা যায় যে, কর্ম-কর্তব্যবাদীদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যটি আমাদের কাছে কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। লক্ষ্যের বিভ্রান্তিতে তাই কর্ম-কর্তব্যবাদীদের মতবাদটি অচল হয়ে পড়ে।
[5] নিয়ম ব্যতিরেকে করণীয় কর্তব্যের বিচার অসম্ভব
কর্ম-কর্তব্যবাদীরা নিয়ম ছাড়াই কেবল পরিস্থিতিকে বিচার করেই আমাদের করণীয়-কর্তব্য স্থির করতে চেয়েছেন। আবার পরিস্থিতিগুলিকে অহরহ পরিবর্তিত ও নিত্যনতুন রূপেও উল্লেখ করেছেন। আর তাই যদি হয়, তাহলে নিত্যনতুন পরিস্থিতিগুরি বিচার কীভাবে সম্ভব? এর কোনো সদুত্তর কর্ম- কর্তব্যবাদীরা দিতে পারেননি। অধ্যাপক হেয়ার (Hare) তাই বলেন, কোনো নিয়ম ছাড়া নৈতিক শিক্ষা বা নির্দেশ কখনোই সম্ভব নয়। সে কারণেই বলা যায় যে, কর্ম-কর্তব্যবাদীদের অভিমতটি কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
[6] সার্বিক পরিস্থিতিমূলক বিশেষ অবধারণ
কর্ম-কর্তব্যবাদীরা যে পরিস্থিতির বিচারের কথা বলেছেন, সেগুলিকে তাঁরা বিশেষ বিশেষ অবধারণের সাহায্যে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ নৈতিক অবধারণগুলিকে তাঁরা বিশেষরূপে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু উল্লেখ করা যায় যে, নৈতিক অবধারণগুলি কখনোই বিশেষরূপে গণ্য হতে পারে না। নৈতিকতার অর্থ তাই শুধু ব্যক্তি মানুষের মধ্যে সীমিত থাকতে পারে না। তার মধ্যে তাই একপ্রকার সার্বিকতার ভাব প্রচ্ছন্নভাবে থেকেই যায়।
কারণ, কোনো এক পরিস্থিতিতে যদি বলা হয় যে, এটা আমার করা উচিত, তাহলে তা শুধু ওই বিশেষ পরিস্থিতিকেই নৈতিকতার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয় না। এর মাধ্যমে এটাই বোঝানো হয় যে, অনুরূপ পরিস্থিতিতে আমাদের সকলেরই এটা করা উচিত। সুতরাং বলা যায় যে, পরিস্থিতিমূলক অবধারণগুলি কখনোই বিশেষ অবধারণের মর্যাদা পেতে পারে না। তাদের মধ্যে একপ্রকার সার্বিকতার ভাব দেখা যায়। এই সমস্ত কারণেই কর্ম-কর্তব্যবাদের বিষয়টিকে গ্রহণ করা যায় না।
3 thoughts on “কর্ম-কর্তব্যবাদের গ্রহণযোগ্যতা আলোচনা করো”